Friday, Apr 19th

Last update09:04:19 PM GMT

: সম্পাদকীয় রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে

রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে

E-mail Print PDF

মোনায়েম সরকার
সম্প্রতি লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েলথ এক্স’ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। সে রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, অতি ধনীর সংখ্যা সবচেয়ে দ্রুত বাড়ছে বাংলাদেশে। ‘ওয়েলথ এক্স’-এর রিপোর্টে তাদেরই অতি ধনী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাদের সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি ডলার বা তার চেয়ে বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশী টাকায় যাদের সম্পদ ২৫০ কোটি টাকার বেশি, তারাই ‘অতি ধনী’ বলে গণ্য হবেন। অতি ধনী মানুষের দেশ বলে যে ১০টি দেশ তালিকার শীর্ষে আছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নেই। কিন্তু বাংলাদেশ সংবাদের শিরোনাম হয়েছে এ কারণে যে, এখানে অতি ধনীর সংখ্যা পৃথিবীর মধ্যে দ্রুত হারে (১৭.৩ শতাংশ) বাড়ছে।
অতি ধনী মূলত কারা হচ্ছেনÑ এমন প্রশ্ন উত্থাপিত হলে দেখা যাবে, যারা ক্ষমতার খুব কাছাকাছি আছেন তারাই দ্রুত ধনী হচ্ছে। ক্ষমতাই ‘অর্থ’। তাই সবাই অর্থের লোভে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চায়। আগে যারা রাজনীতি করতেন, তাদের মধ্যে অর্থের লালসা খুব একটা ছিল না। কিন্তু পৃথিবীর সব দেশেই আজ ব্যবসায়ী রাজনীতিকের ভিড়। ব্যবসায়ীরা ব্যবসার চেয়ে আজ রাজনীতি বেশি পছন্দ করেন। কেন একজন শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী তার ব্যবসায় মনোযোগ না দিয়ে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তা একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, এর পেছনে রয়েছে টাকা আয়ের গোপন অভিলাষ।
রাজনীতি হলো একটি দেশের চালিকাশক্তি। একটি দেশকে নির্মাণ করা এবং সেই দেশের মানুষকে সার্বিক নিরাপত্তা দেয়া রাজনীতির অন্যতম উদ্দেশ্য। বর্তমান বিশ্বে কল্যাণরাষ্ট্রের ধারণা বা তত্ত্ব রাজনীতিকে আরো বেশি সংবেদনশীল ও দায়িত্ববান করে তুলেছে। কল্যাণরাষ্ট্রে নাগরিকের অধিকার পূরণ করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্য। এ কর্তব্যকে কিছুতেই রাষ্ট্র অস্বীকার করতে পারে না। তাই আধুনিক রাষ্ট্র ও রাজনীতি দুটোই এখন আমজনতার সেবা দিতে বাধ্য। কেননা জনতা যদি রাষ্ট্র ও রাজনীতি সম্পর্কে অনাস্থা প্রকাশ করে, তাহলে অবস্থা কতটা ভয়াবহ হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। সারা পৃথিবীর মতো আমাদের বাংলাদেশেও রাজনীতিতে বর্তমানে ব্যবসায়ী অনুপ্রবেশ প্রবণতা সাংঘাতিক আকারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি মনে করি, এটা আমাদের রাজনীতির জন্য অশনিসংকেত। এ অশনিসংকেত বুঝেও যদি আমরা না বোঝার ভান করি, তাহলে আমাদের তৈরি বিপদ আমাদেরই গ্রাস করবে। বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা অনেক বেশি দৃশ্যমান। ব্যবসায়ীরা যেভাবে রাজনীতিতে বেনোজলের মতো ঢুকে পড়ছেন, তাতে দেশের সৎ, যোগ্য ও মেধাবী রাজনীতিবিদরা তো কোণঠাসা হয়ে যাচ্ছেনই, সঙ্গে সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষও বঞ্চিত হচ্ছে যথার্থ সেবা থেকে। এভাবে চলতে থাকলে রাজনীতি একসময় মুখ থুবড়ে পড়বে। অরাজকতা সৃষ্টি হবে রাজনীতির অঙ্গনে, যা আমাদের জন্য মোটেই শুভ হবে না। প্লেটো তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্রের যে চিত্র তুলে ধরেছেন, সেখানে ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করার অধিকার রাখেননি। কারণ তিনি জানতেন, যার যে কাজ তার সে কাজ করাই উচিত। ব্যবসায়ীরা যেখানে হাত দেন, সেখান থেকেই তারা টাকা উপার্জন করার কথা ভাবেন। তারা হাসপাতাল তৈরি করেন টাকার জন্য, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় করেন টাকার জন্য, পত্রিকার মালিকানা বলি আর টিভি চ্যানেলের মালিকানা, সবখানেই আছে টাকা বানানোর মনোবৃত্তি। টাকা কামানোর এত এত পথ থাকতে রাজনীতিতে আসার উদ্দেশ্য কী? ডিউটি ফ্রি গাড়ি, বিলাসবহুল বাড়ি, কম দামে প্লট, বদলি ও নিয়োগ বাণিজ্যসহ বিনা পুঁজিতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা কামানোর জন্য? আগে ব্যবসায়ীরা রাজনীতিতে টাকা লগ্নি করতেন কিন্তু সরাসরি রাজনীতি করতেন না, আজকের চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। এখন দলের জন্য টাকা ব্যয় না করে নিজেই নেমে পড়ছেন রাজনীতিতে। ফলে বদলে যাচ্ছে রাজনীতির ব্যাকরণ। টাটা, বিড়লা, বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেটরা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মালিক হয়েও রাজনীতিতে পা রাখেননি, ব্যবসার দিকে মনোযোগী হওয়াই তাদের প্রধান কাজ ছিল। ব্যবসায়ই তারা সফলতা পেয়েছিলেন। আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদেরও অনুরোধ করবÑ রাজনীতিকে টাকা বানানোর যন্ত্র না বানিয়ে নিজের ব্যবসায় মন দিন। তাতে দেশের অর্থনীতি সবল হবে, প্রকৃত রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করার সুযোগ পাবেন। যারা আমাদের প্রবীণ রাজনীতিক বা রাজনৈতিক কর্মী, তারা জানেন ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকারে যারা মন্ত্রিসভার সভ্য ছিলেন, তাদের বেশির ভাগই ছিলেন সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ, উকিল ও ডাক্তার। যেমনÑ খয়রাত হোসেন, শেখ মুজিবুর রহমান, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, আতাউর রহমান খান, শরৎ চন্দ্র মজুমদার, মাহমুদ আলী, হাসিম উদ্দিন আহমদ, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মনোরঞ্জন ধর, মসিউর রহমান প্রমুখ। অধ্যাপকরাও সে সময়ের রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় ছিলেন। অতীতে রাজনীতির অঙ্গনে আমরা সেই মানুষগুলোকেই দেখেছি, যারা দেশের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ নেতা ছিলেন। আজ যারা ব্যবসায়ী নেতা, যারা টাকার জোরে রাজনীতির মঞ্চে এসে প্রবেশ করেছেন, তাদের কাছে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষা সবকিছুই ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীরা টাকা ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। এরা রাজনীতিকে টাকা কামানোর অন্যতম শক্তিশালী উৎস বলেই মনে করেন। বঙ্গবন্ধুর সময়েও এ প্রবণতা আমরা দেখিনি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিকে এদিকে ঠেলে দেন। তিনি বলেন, ‘ও ংযধষষ সধশব ঢ়ড়ষরঃরপং ফরভরপঁষঃ ভড়ৎ ঢ়ড়ষরঃরপরধহং.’ তিনি আরো বলেন, ‘গড়হবু রং হড় ঢ়ৎড়নষবস.’ এই যে জিয়ার ‘রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে তোলা’ এবং ‘টাকা কোনো সমস্যা নয়’ বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতিকে হিং¯্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত করে তোলে। আমরা দেখি বিএনপি গঠন করার জন্য জিয়াউর রহমান দেশ রক্ষার মহান কাজে নিয়োজিত সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করেন এবং কতিপয় সেনা কর্মকর্তাকে মন্ত্রীর মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন। তিনি এমন এমন ব্যক্তিকে রাজনীতির মাঠে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন, যারা দেশের চিহ্নিত অপরাধী ও অবৈধ টাকার মালিক। তাছাড়া দেশদ্রোহী রাজাকারদের জিয়াই প্রথম রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন। ফলে অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের রাজনীতিতে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হয়। এরপর আসেন আরেক জেনারেল হোসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনিও জিয়ার মতো জাতীয় পার্টি গঠন করেন সেনা সদস্য, অস্ত্র ও টাকার ওপর ভিত্তি করে। ছাত্রদের হাতে অর্থ ও অস্ত্র তুলে দিয়ে ছাত্ররাজনীতিকে হত্যার জন্য জিয়া ও এরশাদের কুটিল ভূমিকা চিরদিন বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ মনে রাখবে। এরশাদের জাতীয় পার্টিতেও একে একে এসে যোগ দেন সুযোগসন্ধানী আমলা, সেনা কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ীরা। এরশাদের পরে ১৯৯১ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হলে সেই নতুন সরকারের মধ্যেও দেখা যায় ব্যবসায়ী নেতা, সামরিক ও আমলাতান্ত্রিক আধিপত্য। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারে শুধু ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতাই নন, সেখানে ধীরে ধীরে জঙ্গিরাও অনুপ্রবেশ করে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো রাজনৈতিক দল। সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহ্যবাহী দলের কাছে দেশের সাধারণ মানুষ গঠনমূলক রাজনীতি প্রত্যাশা করে। কিন্তু আওয়ামী লীগও ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের মধ্যেও এখন ব্যবসায়ী নেতাদের আনাগোনা একেবারে কম নয়। যেহেতু সব দলেই এখন ব্যবসায়ীদের জয়জয়কার এবং টাকা ছাড়া যেহেতু নির্বাচনে জয়লাভ করা বর্তমান সময়ে কঠিন, তাই আওয়ামী লীগও অন্যান্য দলের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিচ্ছে। এ ছাড়া যে আর কোনো উপায় নেই! যদি আমরা বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে একটু ভালো করে তাকাই তাহলে দেখব, তৃণমূল পর্যায় থেকেই শুরু হয়েছে রাজনীতিতে টাকাওয়ালা বা ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ। যার টাকা আছে তার পেছনেই লোক আছে, যেকোনো জায়গায় টাকাওয়ালার জন্য চেয়ার আছে। ফলে টাকা ইনভেস্ট করতে টাকাওয়ালারা মোটেই দ্বিধা করেন না। আজকের দিনে সমাজে একজন সৎ মানুষের চেয়ে টাকাওয়ালা মানুষের দাম বেশি। যেহেতু টাকার দাম বেশি, তাই টাকা যাদের আছে তারাই তো সমাজপতি হবেন। আগে জ্ঞানীরা সমাজপতি হতেন, এখন ধনীরা সমাজপতি হন। এ চিন্তাচেতনা ভ্রান্ত মানসিকতার পরিচয় বহন করে। এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে সমাজ কিছুদিন পরেই নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়বে। পৃথিবীতে রাজনীতি কোনো সহজ কাজ নয়। যেকোনো লোকের পক্ষেই রাজনীতি করা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। ব্যবসায়ীরাই যদি রাজনীতি করতে পারতেন, তাহলে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা, এ জে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানরা রাজনীতি করে মানুষের এত কাছে যেতে পারতেন না, জনগণকে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ উপহার দিতে পারতেন না।
ব্যবসায়ীদের কাজ হলো মুনাফা করা, মানুষের দাবিদাওয়া পূরণ করা নয়। তাদের কাছে মানুষের চেয়ে টাকার দাম বেশি। পক্ষান্তরে প্রকৃত রাজনীতিবিদদের কাছে টাকার চেয়ে মানুষের দাম বেশি। দুটি বিপরীত বিশ্বাস নিয়ে দুই মেরুতে দাঁড়িয়ে আছেন প্রকৃত রাজনীতিবিদ আর ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদরা। আমরা যদি এখনই রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদের পার্থক্য বুঝতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে দুঃখ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। ভবিষ্যতের কথা ভেবে আসুন আজ থেকেই প্রকৃত রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি তুলে দিই। বিদায় জানাই ব্যবসায়ী রাজনৈতিক নেতাদের। রাজনীতিকে ব্যবসায়ীদের হাত থেকে বাঁচাতে হলে জনতার সচেতনতা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। কেননা জনতাই পারে রাজনীতি না-জানা টাকাওয়ালা ব্যবসায়ীদের রাজনীতির ব্যাকরণ শিক্ষা দিতে।
লেখক: রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট

Share this post