Friday, May 03rd

Last update09:04:19 PM GMT

: সম্পাদকীয় আকাক্সক্ষার স্থল ও উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ

আকাক্সক্ষার স্থল ও উন্নয়নের রোল মডেল বাংলাদেশ

E-mail Print PDF

সেলিম জাহান

শোনা গেল, পাকিস্তান নাকি বাংলাদেশ হতে চাইছে। না, সুইডেন হতে চায় না তারা, চায় বাংলাদেশ হতে। তাজ্জব কি বাত! বলতে ইচ্ছে করে, ‘এ কি কথা শুনি আজি মন্থরার মুখে?’ মনে আছে কি, বাংলাদেশ পাকিস্তানের উপনিবেশ ছিল প্রায় সিকি শতাব্দী? শোষিত হয়েছে সর্বক্ষেত্রে এ দীর্ঘ সময়ে? বাংলাদেশে পৃথিবীর জঘন্যতম নারকীয় হত্যাকা-ে মেতেছিল পাকিস্তান? স্বাধীনতার জন্য আমাদের লড়তে হয়েছে একটি রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম? কতটা মূল্য দিয়েছি আমরা জীবনের, রক্তের এবং সম্ভ্রমের বিনিময়ে? মনে কি পড়ে না যে স্বাধীনতার পরে একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশ, ভূখ- ও অর্থনীতি আমরা পেয়েছিলাম? স্পর্ধিত উচ্চারণে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে আমাদের কি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলা হয়নি?
তা এমন খায়েশ কেন পাকিস্তান নামের ভূখ-টির? আহা, অমন করে বলছি কেন, ভালো কে না হতে চায়? বিশ্ব তো জানে, ১৯৭১-এর ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশ নিজেকে তুলে এনেছে, প্রতিষ্ঠিত করেছে বিশ্বসভায়, দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেছে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে। বাংলাদেশ আজ তাই ভালো আছে, ভালো করছে এবং আরো ভালোর চেষ্টা যে করছে, তার প্রমাণ তো দৃশ্যমান। ভালো কত কিছুই তো ঘটেছে বাংলাদেশের ৪৭ বছরের জীবনে। আর্থসামাজিক বিষয় দিয়েই শুরু করি না কেন? কতজন মনে করতে পারবেন যে মধ্য সত্তরে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল আট কোটির মতো আর পাকিস্তানের সাত কোটি। অর্থাৎ ভূখ-ের দিক থেকে আমাদের চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বড় পাকিস্তানের জনসংখ্যার চাপ অনেক কম ছিল। আজকে কি অবস্থা? আজ আমাদের জনসংখ্যা ১৬ কোটি, পাকিস্তানের ২১ কোটি। অনেক কম আয় সত্ত্বেও বাংলাদেশ যেভাবে জনসংখ্যার অশ্বকে বাগ মানিয়েছে, তাতে দেশটি বিশ্বের একটি অভাবনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। পাকিস্তানের অন্যতম গর্বের জায়গা ছিল তাদের প্রবৃদ্ধির হার আর উচ্চ মাথাপিছু আয়। না, সেখানেও ফাটল ধরেছে। ইদানীংকালে উপাত্তে বেরিয়েছে, ইতিহাসে এই প্রথম বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়কে ছাড়িয়ে গেছে। বাজার বিনিময় ডলারমূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৫৩৮ মার্কিন ডলার, আর পাকিস্তানের ১ হাজার ৪৭০ মার্কিন ডলার। কেমন করে হলো? হিসাব সোজা। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে যেখানে গড় প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ থেকে ৭ শতাংশের মতো, সেখানে পাকিস্তান তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। উঁহু, পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের এ রকমের মাথা উঁচু করা ঐতিহাসিক অর্জন শুধু তো আয় কিংবা জনসংখ্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, অহঙ্কার করার মতো প্রাপ্তি তো আমাদের অন্যান্য সামাজিক বিষয়েও আছে। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু যেখানে ৭২ বছর, পাকিস্তানের সেখানে ৬৬ বছরÑ ছয় বছর কম। শিশুমৃত্যুর হার আমাদের যেখানে প্রতি হাজারে ৩১, পাকিস্তানে তা ৬৬Ñ আমাদের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। আমাদের মেয়েদের ৪২ শতাংশের যেখানে মাধ্যমিক শিক্ষা আছে, সেখানে পাকিস্তানের কত জানেন? সাকল্যে ২০ শতাংশ। শুধু পরিমাণগত দিক থেকে নয়, গুণগত দিকেও বাংলাদেশের অর্জন অনেক। বাঙালিদের কর্মকুশলতা ও সৃজনশীলতা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়েছেÑ পোশাক শিল্প ও বিদেশে বাঙালি শ্রমিকরাই তার প্রমাণ। আমাদের অহঙ্কারের জায়গা আমাদের তরুণ সমাজÑ স্বদেশে ও বিদেশে, বিশেষত আমাদের মেয়েরা। আমাদের মেয়েদের বহুধা অর্জনে আমরা উদ্দীপ্ত, বিদেশে আমাদের দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের সাফল্যে আমরা গর্বিত। নাগরিক সমাজের বিস্তার গণতান্ত্রিক কাঠামোকে একটি বিস্তৃততর অবস্থানে নিয়ে গেছে। পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের অহঙ্কারের জায়গা তো বিস্তৃত আন্তর্জাতিক বলয়েও। এই যে বিশ্বের নানা জায়গায় আমাদের ভাইবোনেরা শান্তিরক্ষীর ভূমিকা পালন করছে, তারা যেমন প্রশংসিত তাদের বিশ্বস্ততা, নিরপেক্ষতা ও মানবিকতার জন্য, তেমনটা শুনিনি অন্যান্যের ক্ষেত্রে। পূর্ব তিমুরে বাঙালি শান্তিরক্ষী স্থানীয় জনগণের জন্য প্রাণ দেয়, দক্ষিণ সুদানে দেখেছি তাদের স্থানীয় বুভুক্ষু জনগণের সঙ্গে খাবার ভাগ করে নিতে, হাইতিতে কলেরাপীড়িত অঞ্চলে সেবা করতে গিয়ে কলেরায় মারা যেতে।
তাই তো যখন দেখি পূর্ব তিমুরের একটি গ-গ্রামে গ্রামবাসীই বাংলাদেশের ছেলে, শান্তিরক্ষী শহীদ মনিরুল ইসলামের জন্য বড় মমতায় শেষ শয্যা রচনা করে দিয়েছে, তার পাশে দাঁড়িয়ে চোখভরা অশ্রু নিয়ে কৃতজ্ঞ হয়েছিলাম। সিয়েরা লিওন যখন বাংলাকে ওই দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছিল তখন গর্বে উদ্বেলিত হয়েছিলাম। যখন আমার এক সময়ের সহকর্মী, হাইতির এক প্রধানমন্ত্রী তার মন্ত্রিসভার সামনে আমাকে সংবর্ধিত করেছিলেন বাংলাদেশী বলে, তখন নমিত হয়েছিলাম। বাংলাদেশ যখন সচেষ্ট থেকেছে উঁচুতে, আরো উঁচুতে উঠতে, তখন পাকিস্তানে কী হয়েছে? পাকিস্তানে আল কায়েদা গেড়ে বসেছে। মৌলবাদী সন্ত্রাস ছড়িয়ে পড়েছে দেশটির পুরো ভূখ-ে, প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে নানা মানুষ। তখন পাকিস্তানকে ক্ষয়িষ্ণু, এমনকি ব্যর্থ রাষ্ট্র বলেও অভিহিত করা হয়েছে। সমাজে সামন্তবাদ আরো জোরালো হয়েছে, নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য আরো বেড়েছে, গণতান্ত্রিক কাঠামোতে আঘাত এসেছে বারবার। ক্ষয়িষ্ণু কিংবা ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে অনেক সময় অনেকে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন যে পাকিস্তান সিরিয়া, লিবিয়া কিংবা ইয়েমেনের মতো হয়ে যাচ্ছে কিনা। জ্ঞান-অভাবগ্রস্ত অনেকে অবশ্য কখনো কখনো বাংলাদেশ প্রসঙ্গে সিরিয়াকে মিলিয়ে দেখতে চাইছেন। সৎ উদ্দেশ্য নয় অবশ্যই। তথ্য দিই একটু। বিগত দশকে বাংলাদেশ যখন মানব উন্নয়নে শনৈঃশনৈ এগিয়ে যাচ্ছে, তখন সিরিয়া নামছে, কেবলই নামছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের মানব সূচক যেখানে এগিয়েছে সাত ধাপেরও বেশি, সিরিয়ার সূচক পড়ে গেছে ২৮ ধাপ। বাংলাদেশ নিম্ন থেকে মধ্যম মানব উন্নয়নে উন্নীত হয়েছে, সিরিয়া নেমে গেছে মধ্যম থেকে নিম্ন মানব উন্নয়নে। জানেন কি, গত এক দশকে সিরিয়ায় মানুষের গড় আয়ু কমে গত বছর দাঁড়িয়েছে ৬৯ বছরে, বাংলাদেশে যা ৭৩ বছর। পাকিস্তানে তা ৬৬ বছর। সুতরাং সিরিয়ার তুলনাটা পাকিস্তানের সঙ্গেই যাবে ভালো, বাংলাদেশের অবস্থান অন্যত্রÑ ‘হেথা নয়, হেথা নয়, দূরে অন্য কোথা।’ সবকিছু মিলিয়ে দেখলে পাকিস্তান তো বাংলাদেশ হতে চাইবেই। পাকিস্তান যে বাংলাদেশ হতে চাইছে, তাতে বাঙালি হিসেবে এক ধরনের বঙ্কিম আত্মতৃপ্তি আছে আমার। এটা আমার জন্য সংবাদ নয়, আমার জন্য অহঙ্কার। কিন্তু সে ভিন্ন আর কোনো মাথাব্যথা নেই। পাকিস্তান চাইলেই বাংলাদেশ হতে পারবে কিনা, তা নিয়েও আমি ভাবি না; আমার কিছু যায় আসে না তাতে। তবে আমার যায় আসে তিনটে বিষয়েÑ এক. যেখানেই থাকি না কেন, বাংলাদেশ আমার গর্ব; যেখানেই যাই না কেন, এক টুকরো বাংলাদেশ হূদয়ে বয়ে নিয়ে যাই; যা-ই দেখি না কেন, সেখানেই বাংলাদেশ খুঁজি।
দুই. চাইতে পারে পাকিস্তান বাংলাদেশ হতে, বাংলাদেশ কিন্তু কখনো পাকিস্তান হতে চাইবে না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধূলিসাৎ করার ষড়যন্ত্রে যারা মাতেন, তারা যাতে ভুলে না যান যে বাংলাদেশ ভাঙে না, বাংলাদেশ দমে না, বাংলাদেশ পাকিস্তান নয়Ñ ইতিহাস অতীতেও এটা প্রমাণ করেছে, ভবিষ্যতেও করবে।
তিন. বাংলাদেশ যাদের অহঙ্কার, বাংলাদেশ যাদের গর্ব, হূদয়ে বাংলাদেশকে যারা বহন করে, আমি তাদেরই একজন। এর চেয়ে বেশি কিছু যোগ্যতা আমার নেই, করিনি দেশের জন্য তেমন কিছুই, শুধু একবার এক সভায় বাংলাদেশের পক্ষে বলতে উঠে সমুচিত জবাব দিয়েছিলাম চার দশক আগে উচ্চারিত একটি স্পর্ধিত বাক্যের। এটুকুই শুধু, আর কিছু নয়।
লেখক: অর্থনীতিবিদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক; নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক

Share this post